Monday, June 11, 2012

রংপুরে মাদকের হাটে মেয়েরাও



              রংপুরে মাদকের হাটে মেয়েরাও!

সূত্র: প্রথম আলো 

রংপুরের সরকারি বেগম রোকেয়া মহিলা কলেজের ইংরেজি বিভাগের এক ছাত্রীর হাতে তাঁর বন্ধুরাই ঘুমের বড়ি তুলে দিয়েছিলেন। ঘুমের বড়িকে মাদক হিসেবে ব্যবহার শুরু করেন ওই ছাত্রী। অল্প দিনের মধ্যেই বড়ি খাওয়ার পরিমাণ বেড়ে যায়। একপর্যায়ে ফেনসিডিলও খেতে শুরু করেন। মাদক কেনার টাকার জন্য রুমমেটদের জিনিসপত্র চুরি করতে গিয়ে ধরাও পড়েন।
রংপুরের মাদকাসক্ত নিরাময়, গবেষণা পুনর্বাসন কেন্দ্রলাইট হাউস’-এর ব্যবস্থাপক গুলশান আরা ইয়াসমীন বলেন, শেষ পর্যন্ত চিকিৎসা দিয়ে ছাত্রীটিকে সুস্থ করা সম্ভব হয়েছে। তবে মাদক নিচ্ছে এমন ছাত্রীর সংখ্যা রংপুরে অনেক। তাঁদের জরিপে দেখা গেছে, রংপুরে মাদকাসক্তদের ২০ শতাংশ নারী, যাদের ৭০ শতাংশ ছাত্রী। এদের বয়স ১৩ থেকে ১৯ বছরের মধ্যে।
রংপুরে মাদকের ভয়াবহতা নিয়ে অনেক গল্প শোনা যায়। অন্যান্য এলাকার চেয়ে রংপুরের গল্প আলাদা। এখানে ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরা আসক্ত হচ্ছে। নিয়ে ভীষণ কষ্টে আছে অনেক পরিবার। শহরের অনেকেই বলছেন, মেয়েরাও নেশায় জড়িয়ে পড়লে সমাজ, পরিবার কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?
পুলিশ, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর মাদক নিরাময় সংস্থাগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রংপুর শহরে আট থেকে ১০ হাজার তরুণ-তরুণী মাদকাসক্ত। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোর মধ্যে রংপুর সবচেয়ে বেশি মাদকপ্রবণ এলাকা।
রংপুর কেন মাদকের কেন্দ্র হলো: রংপুর শহর কেন মাদকের কেন্দ্র হয়ে উঠল? প্রশ্নের সহজ উত্তর পাওয়া যায় না। শহরের অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শহরে মাদক সহজলভ্য। অন্য জেলা থেকে, সীমান্ত পার হয়ে মাদক এখানে আসে। তবে শহরে কোনো বড় মাদক ব্যবসায়ী নেই।
দিনাজপুর জেলার ঘোড়াঘাট, নবাবগঞ্জ, হিলি, বিরামপুর; কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ী, ভূরুঙ্গামারী; লালমনিরহাটের মোগলহাট; কালীগঞ্জ সীমান্ত পার হয়ে রংপুরের পীরগঞ্জ মিঠাপুকুর গঙ্গাচড়ার বিভিন্ন এলাকা দিয়ে মাদকদ্রব্য রংপুরে আসছে। লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা সীমান্ত দিয়েও মাদক আসে। গত বছর বিডিআরের পক্ষ থেকে বিএসএফের কাছে সীমান্তলাগোয়া যে ৩২টি ফেনসিডিল কারখানার তালিকা দেওয়া হয়েছিল, তার মধ্যে চারটি কারখানা ছিল কুড়িগ্রাম লালমনিরহাট সীমান্তলাগোয়া গ্রামে।
্যাবের মহাপরিচালক হাসান মাহমুদ খন্দকার প্রসঙ্গে বলেন, রংপুর আগে থেকেই মাদকপ্রবণ এলাকা ছিল। শহরটি মাদকের উৎসমুখের কাছে বলে মাদকের ব্যবহার বেশি হতে পারে।
জেলা পুলিশ সুপার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশ মাদক বিক্রেতাদের সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে অভিযান চালাচ্ছে। তবে সব বিক্রেতাকে একেবারে নির্মূল করা যাচ্ছে না।
বেসরকারি জরিপ: গুলশান আরা ইয়াসমীন প্রথম আলোকে বলেন, মাদকাসক্তদের নিয়ে ২০০৪-এর শুরু থেকে ২০০৯ সালের জুন পর্যন্ত একটি জরিপ চালান। তাতে দেখা যায়, রংপুরে মাদক হিসেবে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় হেরোইন ফেনসিডিল। এরপর আছে নেশার ট্যাবলেট বা ইনজেকশন গাঁজা। মাদকসেবীদের ৬৫ শতাংশের বয়স ১৮-৩৫ বছরের মধ্যে। রংপুরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রংপুর মেডিকেল কলেজ, কারমাইকেল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ বেগম রোকেয়া মহিলা কলেজে মাদকসেবীদের সংখ্যা বেশি। তালিকায় ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ রংপুর জিলা স্কুলও আছে। এসব প্রতিষ্ঠানে আসক্তদের মধ্যে ২০ শতাংশ ছাত্রী। ছাত্রীরা বোরকা পরে মাদক কেনে।
অন্য উদ্বেগ: ওই একই জরিপে দেখা গেছে, রংপুর পৌর এলাকায় সুঁইয়ের মাধ্যমে শিরায় মাদক দেয় ৮০০ ব্যক্তি। অন্য সূত্র বলছে, শহরে পেশাদার রক্তদাতার সংখ্যা দেড় শর মতো। রংপুর মেডিকেল কলেজের দুজন চিকিৎসক জানান, পেশাদার রক্তদাতাদের ৮০ শতাংশ মাদকসেবী। কিছুদিন আগে এই হাসপাতালের এক ব্যাগ রক্তে এইচআইভির জীবাণু পাওয়া গিয়েছিল।
অন্যদিকে সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, দেশে শিরায় মাদকসেবীদের মধ্যে এইচআইভির সংক্রমণ সবচেয়ে বেশি। মাদক নিরাময় কেন্দ্রফেরা’-এর পরিচালক আলমগীর হোসেন বিষয়ে তাঁর উদ্বেগের কথা জানান।
কোথায় বেশি মাদক: শহরের ১১৭টি জায়গায় হরদম মাদক কেনাবেচা হয়। সবচেয়ে বেশি মাদক বিক্রি হয় স্টেশন রোডে। কলেজ রোড, টার্মিনাল, হনুমানতলা, ডিসি অফিস এলাকা, রেলওয়ে বস্তি, বাবুপাড়া, খামারপাড়া, আলমনগর, লালবাগ, চুরিপট্টি, আশরতপুর, এরশাদনগর, তাজহাট, মাহীগঞ্জ, শাপলা চত্বর, শালবন বেবিস্ট্যান্ড, বৈরাগীপাড়া, মডার্ন মোড়, পার্কের মোড়, ইসলামপুর, মেডিকেল পূর্ব গেট, মুলাটোল পাকার মাথা, কবরস্থান, কেল্লাবন্দ, শহীদ মিনার, সুরভি উদ্যান চিড়িয়াখানা এলাকা মাদক বিক্রির জন্য পরিচিত। শহরে খুচরা বিক্রেতার পাশাপাশি আছেহোম সার্ভিস ফোন করলেই বাড়িতে মাদক পৌঁছে দেয়। হারাগাছ পৌর এলাকার সবচেয়ে বেশি মাদক বিক্রি হয় সারাই বাজার, চাঁদনী বাজার, আমবাগান, জয় বাংলা মোড়, ভিতর কুঠি, বানুপাড়া, চতুরা, দরদী বাজার, মায়া বাজার, মেনাজ বাজার, দালাল হাটখোলা, কাউনিয়া সদরের মীরবাগ রেলস্টেশন, হলদী বাড়ি, তকিবল বাজার, স্টেশন বাজারসহ তিস্তার বিভিন্ন চর এলাকা।
সালেহ মোহাম্মদ তানভীর প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশ সাধ্যমতো অভিযান চালিয়ে অপরাধীদের গ্রেপ্তার করছে।
মামলা গ্রেপ্তার: রংপুরে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. আহসানুর রহমান প্রথম আলোকে জানান, ২০০৯ সালে বৃহত্তর রংপুরের পাঁচটি জেলায় মাদকবিরোধী এক হাজার ২৯টি অভিযান হয়েছে। ঘটনায় মামলা হয়েছে ৪৩৮টি, এতে আসামি আছে ৪৬২ জন, গ্রেপ্তার হয়েছে ১২৮ জন, পলাতক আসামির সংখ্যা ৩৩৪। উপপরিচালক আরও জানান, গত বছর ২৪ জনের সাজাও হয়েছে। এখন পর্যন্ত দুই হাজার ৫৫৭টি মামলা বিচারের অপেক্ষায় আছে। তিনি বলেন, একবার গ্রেপ্তার করা লোকজনই ঘুরেফিরে আবার জামিনে পেয়ে এসে মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছে এবং গ্রেপ্তার হচ্ছে।
মো. আহসানুর রহমান বলেন, লোকবলের অভাব যানবাহনসংকটের কারণে মাদকবিরোধী অভিযান সফলভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হয় না। তিনি বলেন, মাদকে কেনাবেচার খবর পাওয়ার পর তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনাস্থলে যাওয়া সম্ভব হয় না, ততক্ষণে মাদক ব্যবসায়ীরা সরে পড়ে। মাদক ব্যবসা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রংপুরে তেমন বড় ব্যবসায়ী নেই, সবাই খুচরা ব্যবসায়ী।
পরিস্থিতি ভয়াবহ হচ্ছে: ধরনের শহরে নেশার প্রকোপ এত বেশি কেন? এই প্রশ্নের উত্তরে রংপুর মেডিকেল কলেজের মনোরোগ চিকিৎসক আবুল মোমেন প্রথম আলোকে বলেন, তরুণেরা বেকার, হাতে কোনো কাজ নেই। একজনকে দেখে আরেকজন আসক্ত হচ্ছে, ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরাও। তিনি বলেন, যদি একজন মাদকসেবী দৈনিক ৫০ টাকার মাদক সেবন করে, তাতেও বিপুল পরিমাণ অর্থ মাদকের পেছনে ব্যয় হচ্ছে।
রংপুর মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ আবদুর রউফ বলেন, রংপুর শহরের পরিবারগুলো লোকলজ্জার ভয়ে তাদের সন্তানদের আসক্তির কথা সহজে প্রকাশ করে না। বিশেষ করে মেয়েরা মাদকাসক্ত হলে শহরের বাইরে নিয়ে চিকিৎসা করার ব্যবস্থা করেন। তিনি বলেন, জেলার আইনশৃঙ্খলাসংক্রান্ত সভায় মাদক নিয়ে অনেক আলোচনা হয়, কিন্তু কাজের কাজ হয় না। মাদক নিরাময় কেন্দ্রফেরা’-এর পরিচালক আলমগীর হোসেন বলেন, রংপুরের পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। দিনে দিনে এই পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করছে

No comments:

Post a Comment