Tuesday, June 12, 2012

মাছের বাজারে এখন মাছি নেই

               মাছের বাজারে এখন মাছি নেই



মাছের বাজারে মাছির দেখা পাওয়া যাচ্ছে না, আবার আঁশটে-পঁচা গন্ধও নেই। রাজধানীর বাজারে মাছগুলোতে ফরমালিন এবং মৃত মাছের ফুলকায় সিঁদুর দিয়ে এসব ক্ষতিকর মাছ বিক্রি করছে অসৎ মাছ ব্যবসায়ীরা। সে সঙ্গে ছোট আকারের লালচে ও হলুদ রঙের মাছে ব্যবহৃত হচ্ছে জর্দাপোলাও রান্নায় ব্যবহৃত রঙ জাফরান। মাছগুলোকে পচনের কবল থেকে রক্ষা করতে ব্যবহার করা হয় ফরমালিন বা বিভিন্ন কেমিক্যাল। ফলে মাছ ... বাজারে মাছির আনাগোনা নেই। ক্রেতারা মাছ ব্যবসায়ীদের দ্বারা হচ্ছে প্রতারিত। সে সঙ্গে সিঁদুর ও ফরমালিনযুক্ত মাছ মানুষের দেহে ক্ষতিগ্রস্ত প্রভাব ফেলছে। রাজধানীর ছোট-বড় বিভিন্ন বাজারের মাছ বিক্রেতা ও ক্রেতাদের সঙ্গে আলাপকালে এসব তথ্য জানা যায়। এ ব্যাপারে মৎস্য বিশেষজ্ঞ তারেক সরকার জানান, মাছে ফরমালিন মেশানোর ফলে মাছের বাজারে আর কোনো আঁশটে-পচা গন্ধও নেই। মাছিদের ঘ্রাণশক্তি অত্যন্ত প্রখর এবং ফরমালিনের গন্ধ পছন্দ না হওয়ায় মাছের ওপর মাছি বসছে না।
রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, সোয়ারীঘাট ও নিউমার্কেট প্রভৃতি মাছের আড়তে গিয়ে দেখা যায়, কোনো আঁশটে-পচা গন্ধ নেই। কেবল কারওয়ান বাজারে নোংরা ড্রেনের কারণে সেখানে আঁশটে-পচা গন্ধ পাওয়া গেলেও কোনো আড়তেই মাছি নেই। খুচরা মাছের বাজার মোহাম্মদপুর, নিউমার্কেট, মিরপুর-১ নম্বর এবং কাঁঠালবাগানে গিয়ে কোনো মাছের ওপরই মাছির উপস্থিতি দেখা যায়নি। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ঢাকায় মাছ আসতে এক থেকে দুই দিন এবং বিদেশি মাছ বিশেষ করে মিয়ানমার ও ভারত থেকে আসতে সময় লাগে পাঁচ থেকে সাত দিন। মাছ বিক্রেতারা জানিয়েছেন, এই সময়ে শুধু বরফ দিয়ে মাছের পচন রোধ করা প্রায় অসম্ভব বলে তাঁরা ঝুঁকি নিতে চান না।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আড়তের চেয়ে খুচরা বাজারগুলোতে মাছে এসব দুই নাম্বারি কাজ বেশি হয়। দেশের বাইরে থেকে যেমন ভারত ও মিয়ানমার থেকে যেসব মাছ আসে সেসব মাছ খুচরা বাজারে পৌঁছতে ৬-৭ দিন সময় লাগে। কাজেই কেমিক্যাল ছাড়া এসব মাছ খুচরা বাজারে আসতে না আসতে নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে। নগরীর বিভিন্ন মাছ বাজারে গিয়ে দেখা যায়, প্রচুর মাছ থাকলেও নেই মাছি। কিন্তু এখন সেটা ছোট ছোট মাছে দেখা গেলে বড় মাছের আশপাশেও দেখা যায় না। এ ব্যাপারে জুরাইন বাজারের মাছ বিক্রেতা আলমগীর জানান, শুনেছি ফরমালিন বা কেমিক্যাল থাকলে মাছি আসে না। তবে এখানে মাছে কোনো কেমিক্যাল দেওয়া হয় না বলে জানান তিনি। মাছ বিক্রেতা আফজাল বলেন, জাফরান রঙ দিয়ে প্রকৃত রঙ ফিরিয়ে আনা হয়। কারওয়ান বাজারের মাছ ব্যবসায়ী হালিম জানান, মাছে ফরমালিন না দিলে স্বল্প সময়ে তা নষ্ট হয়ে যায়। তাই বাধ্য হয়ে এ কাজ করা হয়। মোহাম্মদপুর বাজারের মাছ ব্যবসায়ী আলী হোসেন জানান, শুধু মাছেই নয়, জিনিস ভালো রাখার জন্য কাঁচা ফলসহ অনেক জিনিসেই ফরমালিন দেয়া হয়। তবে কই, মাগুর, শিং, তেলাপিয়া মাছ ফরমালিন না দিয়েও ৩-৪ দিন রাখা যায়। কিন্তু রুই, কাতল, পাঙ্গাস, বোয়াল, ইলিশসহ বড় মাছে ফরমালিন দিতে হয়। এ ছাড়া অনেক ক্রেতা জানান, মাছে আগের মতো স্বাদ-গন্ধ পাওয়া যায় না। যাত্রাবাড়ীর মাছ ব্যবসায়ী আনোয়ার জানান, দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মাছ আনা হয় ঢাকা শহরের বিভিন্ন বাজারে। ওইসব জায়গা থেকে মাছ আসতে কখনো ২ দিন লেগে যায়। এ সময়ের মধ্যে বরফ দিয়ে পলিথিনে মুড়িয়ে মাছ রাখলে মোটামুটি ভালো থাকে। কিন্তু মাছ বাজারে আনার পর পলিথিন থেকে বের করে একদিনে বিক্রি না হলে মাছে পচন ধরে। এ থেকে রেহাই পেতে মাছগুলোতে ফরমালিন জাতীয় ওষুধ দেওয়া হয়। কাপ্তান বাজারের এক মাছ ব্যবসায়ী জানান, বড় মাছগুলো ভালো থাকার জন্য বরফ দেয়া হয়। কিন্তু এতে ২ দিনের বেশি রাখা যায় না। মাছে বরফ দেওয়ায় ২ দিনে মাছ ও ফুলকা সাদা হয়ে যায়।
ফরমালিনের খোঁজে : ভোর ৪টা ৫০ মিনিট। কারওয়ান বাজার মাছের আড়ত। তখনো ট্রাক থেকে মাছ নামানো শুরু হয়নি। বেশির ভাগ মাছ এসেছে বাগেরহাট, খুলনা ও মেঘনা ঘাট থেকে। ট্রাক থেকে মাছ নামানোর পর বেশির ভাগ মাছ হাফ ড্রামে রাখা পানিতে ধোয়া হলো। কাছে গিয়ে ফরমালিনের ঝাঁজ বুঝতে পারলে একজন আড়তকর্মী বলেন, পানিতে একটু ওষুধ দেয়া হয়েছে। কেন ফরমালিন দেয়া হচ্ছে? উত্তরে তিনি জানান, ওষুধ না দিলে মাছ পচে যাবে।
যাত্রাবাড়ী মাছের আড়ত : সকাল ৬টা ২০ মিনিটের কাছাকাছি। এখানকার অবস্থাও কারওয়ান বাজারের মতোই। হাফ ড্রামে ফরমালিন মেশানো পানিতে মাছ ধুয়ে তোলা হচ্ছে। জানতে চাইলে আড়তকর্মীরা বলেন, পানিতে কিছু নেই। পানিতে ঝাঁজ কেন? উত্তরে আড়তকর্মী বলেন, এটা মাছের গন্ধ। যাত্রাবাড়ী মাছের আড়ত ঘুরে নিউমার্কেট মাছের আড়তে আসতে আসতে তখন ৭টা ২৫ মিনিট। ইতিমধ্যে এখানকার আড়ত থেকে মাছ কিনে খুচরা দোকানিরা বাজারে প্রবেশ করেছেন। আড়ত থেকে কেনা মাছ পানিভর্তি প্লাস্টিক বালতির মধ্যে ফরমালিন মেশানো পানিতে ধুয়ে তুলতে ব্যস্ত প্রায় সবাই। মাছ বিক্রেতারা বলেন, একটু-আধটু ওষুধ না দিলে মাছ পচে যায়। এভাবেই প্রতিদিন রাজধানীর বাজারে মাছ প্রবেশ করার সময় ফরমালিন মেশানো পানিতে ধোয়া হয়। ফরমালিন কী : রংহীন অনেকটা পানির মতো ফরমালডিহাইড গ্যাসের দ্রবণ হলো ফরমালিন। আমাদের দেশে প্রাপ্ত ফরমালিনে ৩৭ থেকে ৪০ শতাংশ ফরমালডিহাইড রয়েছে। অবশিষ্ট পানি এবং মিথানল। বিভিন্ন জৈব পদার্থ, বিশেষ করে মৃত প্রাণীর শরীর সংরক্ষণ করতে ফরমালিন ব্যবহৃত হয়। বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়াসহ জীবাণুনাশক হিসেবেও ফরমালিন কাজে লাগানো হয়। ভয়ের কারণ : এই রাসায়নিক দ্রব্য মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর বলে মন্তব্য করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক। তিনি জানান, ফরমালিন কেবল ভোক্তাদের জন্যই নয়, ফরমালিনযুক্ত মাছ বিক্রেতাদের জন্যও ক্ষতিকর।
দেখে চেনার উপায় : বাজারের মাছ দেখে শতভাগ নিশ্চিন্ত হওয়ার উপায় নেই যে কোন প্রজাতির মাছে ফরমালিন মেশানো হয়েছে। তবে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট ফরমালিনযুক্ত মাছ চেনার প্রাথমিক লক্ষণ সম্পর্কে ধারণা দিয়েছে। ফরমালিন দেয়া মাছের চোখ ভেতরের দিকে ঢোকানো থাকবে এবং চোখ থাকবে ফ্যাকাসে।

No comments:

Post a Comment