Monday, July 9, 2012

বস্তুবাদী অপব্যাখ্যার কবলে সালাম-কালাম, হালাল-হারাম এবং কোরবানীর আদর্শ

[এক]
  
বস্তুবাদী এই পৃথিবীতে আজ সব কিছুই পণ্য। আম-ছালাও পণ্য, আমি-আপনিও পণ্য। আম-ছালাকে যেমন বাজারে বেচতে হয়, নিজেকেও তেমনি আজ বাজারজাত করতে হয়। এই বেচা-বিক্রিতে যে যত স্মার্ট সে-ই আজ তত সফল হিসেবে বিবেচিত। এহেন কেনা-বেচার বাজারে আমাদের সময় নেই আত্মার খবর নেয়ার। অথচ আত্মা বিহনে মানুষ যে নিছকই একখন্ড রক্ত-মাংসের পিন্ড বৈ কিছু নয় তাও সে অস্বীকার করতে পারে না। কারণ তাতে তার অস্বিস্তই থাকে না। অবশ্য মুখে অস্বীকার না করলেও প্রতিদিনের কাজে-কর্মে, কথা-বার্তায় সে ঠিকই বুঝিয়ে দেয় যে আত্মা নয় বরং শরীর নামক রক্ত-মাংসের ‘বস্তু’টাই তার কাছে অগ্রগণ্য এবং পূজনীয়। বস্তুপ্রেমী এই মানুষের কাছে তাই আজ তার বুদ্ধি, বিবেক, পারিবারিক বন্ধন, বৈবাহিক সম্পর্ক সবই লাভ-ক্ষতির অংকে হিসেব করার বিষয়। সেই হিসেব থেকে যেন নিস্তার নেই আল্লাহর কালাম, রসূল (সাঃ)-এর বাণী এবং তাঁর হাজারো সাহাবী (রাঃ)-এর রক্ত আর ঘামে ভেজা সুরক্ষিত শিক্ষা ও মহাজ্ঞানেরও।

তাই আল্লাহ কর্তৃক প্রবর্তিত পারস্পরিক সম্বোধন বাক্য ‘আসস্লামু-আলাইকুম’-এর অর্থ ও ব্যাপ্তী বুঝতে আমারা আজ অক্ষম। এটাকে আজ বিবেচনা করা হচ্ছে নিছক ‘হাই-হ্যালো’-এর আরবী ভার্সন হিসেবে। অথচ এই সালামে আছে শান্তি আর নিরাপত্তার সুস্পষ্ট প্রার্থনা ও নিশ্চয়তা যা ‘হাই-হ্যালো’ দূরে থাকুক, পৃথিবীর তাবৎ সম্বোধন সমূহের কোন একটাতেও খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। শান্তির এই আকুতি শুধু রক্ত-মাংসে গড়া দেহটার জন্যেই সীমিত নয় বরং তার ব্যাপ্তী দেহের রন্দ্রে রন্দ্রে উপস্থিত ‘আত্মা’র জন্যেও যা কিনা একান্ত ভাবেই আল্লাহর ‘রূহ’ (১৫:২৯)। এ ছাড়াও তা আরও বিস্তৃত মানুষের সাথে থাকা সেইসব সার্বক্ষণিক সঙ্গী ফেরেশতাদের জন্যেও যাদের উপস্থিতির সাক্ষ্য দেয় পবিত্র আল-কোরআন (১৩:১১; ৮২:১০~১২)। খালি চোখে কোন কিছু দেখতে না পাওয়ার অর্থ যে ‘পরম শূন্য’ নয় সেই সত্যটা আল্লাহ রাব্বুল-আল-আমিনই সর্বপ্রথম তাঁর প্রিয় নবীজী (সাঃ)-এর মাধ্যমে মানব জাতিকে জানিয়েছেন শূন্য ঘরে প্রবেশের সময় সালাম দেয়ার শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে। সেই ঘর অন্যের হলে তো অবশ্যই এমন কি নিজের হলেও তাতে সালাম দিয়ে প্রবেশের নির্দেশ দেয়া হয়েছে (২:১৮৯; ২৪:27~২৯, ৬১)। কারণ দৃশ্যতঃ শূন্য মনে হলেও সেখানেও আছেন আল্লাহর ফেরেশতারা এবং এমন অনেক সৃষ্টি যাদেরকে শুধুমাত্র আল্লাহই জানেন (১৬:৮)।

নামাজ শেষে সালাম ফেরানো তথা সালাম ফিরিয়ে প্রতিটি নামাজ শেষ করার মাঝেও কাজ করেছে ঐ একই দর্শন। এর মাধ্যমে আমাদের ব্যক্তিগত আগ্রহ-অনাগ্রহকে কোন রকম সুযোগ না দিয়ে আমাদের সঙ্গীয় ফেরেশতাদেরকে সালাম প্রেরণে আমাদেরকে বাধ্য করে রাখা হয়েছে যাতে কোন অবস্থাতেই আল্লাহর অদৃশ্য বান্দাদেরকে সালাম প্রদানের বরকত থেকে আমরা বঞ্চিত না হই। সালামের এই দোয়া থেকে বাদ রাখা হয়নি আমাদের মরহুম পূর্ব পুরুষদেরকেও। পবিত্র আল-কোরআনে বর্ণিত নিজের ভাষ্যে আল্লাহ পাক রসূলুল্লাহ (সাঃ)-সহ তাঁর অসংখ প্রয়াত নবী-রসূলকে সালাম (৩৩:৫৬; ৩৭:১০৯, ১২০, ১৩০, ১৮১) দিয়ে পরলোকগত পূর্বসূরীদেরকে কিভাবে সালামের মাধ্যমে স্মরণে রাখতে হয় তা-ই মূলতঃ শিক্ষা দিয়েছেন আমাদেরকে। দরূদ পাঠের মাধ্যমে প্রত্যেক নামাজে আমরা যে রসূলুল্লাহ (সাঃ) ও ইব্রাহীম (আঃ)-কে নিয়মিত সালাম প্রদান করে থাকি তা বস্তুতঃ সেই শিক্ষারই ব্যবহারিক প্রয়োগ বিশেষ। নিয়মিত এই শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে আমরা কবরে শয়িত আমদের প্রিয় স্ব্জনদেরকেও প্রত্যহ সালাম পাঠাবো এটাই সম্ভবতঃ আল্লাহর একান্ত উদ্দেশ্য ও চাওয়া।

তাই নিজের চিন্তা ও নিয়তের মধ্যে একটু ব্যপকতা এনে মানুষ খুব সহজেই তার এই ‘সালাম’ রূপী প্রার্থনার বিনিময় হিসেবে আল্লাহ তা’য়ালার অগণিত দৃশ্য-অদৃশ্য সৃষ্টির কাছ থেকে পেতে পারে প্রত্যুত্তোর রূপী সীমাহীন দোয়া (৪:৮৫~৮৬) যার দ্বারা তার পূণ্যের পাল্লা হতে পারে ভারী তার নিজের অজান্তেই। নিজের ‘প্রিয় সৃষ্টি’ মানুষের কল্যানে এহেন ব্যপক শান্তিময় অমিত পূণ্যের সুব্যবস্থা শুধুমাত্র সর্বোজ্ঞ আল্লাহর পক্ষেই করা সম্ভব। এখানেই শেষ নয়, সালামের এই বাক্য পবিত্র আল-কোরআনের আয়াতও বটে (৩৩:৪৪; ৩৬:৫৮; ৫৬:২৬), যা পাঠ করা, মুখে বলা এবং কানে শোনা সবই সওয়াবের কাজ হতে বাধ্য। সুতরাং এরপরও নিয়মিত ‘সালাম’ বিনিময়ে কর্পণ্য করার কোন সুযোগ আছে কি?


[দুই]

আল্লাহ ও তাঁর রসূল (সাঃ)-এর যাবতীয় আদেশ, নিষেধ, উপদেশ ও শিক্ষার মূল লক্ষ্যই হলো মানুষকে আল্লাহমুখী করে রাখা যাতে সে নিরাপদ থাকে এপারে-ওপারে সবখানে, সব সময়। সেই লক্ষ্য সাধনে প্রয়োজন জীবনব্যাপী একনিষ্ঠ ভাবে শুধু তাঁরই ইবাদত করে যাওয়া। এইসব এবাদত কবুল তথা অর্থবহ হওয়ার জন্য শর্ত হলো হালাল উপার্জন ও হালাল খাদ্য গ্রহণ। হারাম-হালালের বিষয়টা পবিত্র কোরআন ও হাদীসে ব্যাখ্যা করা হয়েছে অত্যন্ত পরিষ্কার ভাষায়, বিশদ ভাবে। এসব ব্যাখ্যা জেনে নেয়ার ক্ষেত্রে আরবী না জানাটাও কোন বাঁধা নয় কারণ ‘ইনফো-টেকের’ এই যুগে বিশ্বের যে কোন ভাষায় এগুলোর অনুবাদ এখন সহজল্ভ্য। তারপরও এই হালাল-হারাম নিয়ে অহরহ হতে দেখা যায় বিস্তর আলোচনা-সমালোচনা এবং ব্যাপক মতভেদ। তবে এইসব কূটতর্ক ও ভেদাভেদ যে কেবলই হীন স্বার্থ সংশ্লিষ্ট তা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে আল-কোরআনের সংশ্লিষ্ট বক্তব্য সমূহের পর্যালোচনায়।

মানুষের জন্য শুয়োর, মদ, রক্ত এবং উচু থেকে পড়ে বা ঘাতে-অপঘাতে মারা যাওয়া প্রাণী সুস্পষ্ট ভাবে হারাম (২:১৭৩; ৫:৩; ৬:১৪৫)। মদ, শুয়োর ও রক্ত যে মানুষের শরীর, মন ও মস্তিষ্ককে কি ভাবে তিলে তিলে ধ্বংস করে তা বিজ্ঞানের এই ব্যপক অগ্রগতির যুগে করো অজানা নয়। তারপরও হাল আমলের মুসলমানদের মধ্যেও এখন অনেকেই শুয়োরের গোশত খেয়ে থাকেন। তাদের মতে যেহেতু শুয়োর এখন এয়ারকন্ডিশন্ড খামারে পরিচ্ছন্ন পরিবেশে পালন করা হয় তাই এটা এখন আর কোন নোংরা প্রাণী নয় অতএব এর গোশত খেতে এখন আর কোন অসুবিধা নেই। এই যুক্তিবাদীরা আসলে জেগে ঘুমিয়ে আছেন, এদেরকে জাগানোর চেষ্টা করা বৃথা। কয়লার ময়লা যে কোন অবস্থাতেই ধুয়ে পরিষ্কার করা যায় না- এই সত্যটা এরা গায়ের জোরে অস্বীকার করতে চান। বক্ষমান আলোচনা এদের জন্য নয়। এদের যাবতীয় প্রশ্নের উত্তরের জন্য এই ভিডিও লিঙ্কটাই যথেষ্টঃ http://www.youtube.com/watch?v=aU5kek3D-4I [Joel Osteen about Pork]

এছাড়া অনান্য পশু-পাখীর গোশত হালাল হওয়ার ক্ষেত্রে শর্ত হচ্ছে সুনির্দিষ্ট যবেহ পদ্ধতি। এই ‘হালাল যবেহের’ কথা শুনলেই যেন মাথা খারাপ হয়ে যায় ‘অত্যাধুনিক’ বস্তুবাদীদের। হালাল এই যবেহ পদ্ধতির কোন যুক্তি বা কারণই তারা খুঁজে পান না। তাই এদের বেশীর ভাগই যবেহ পদ্ধতির পরোয়া না করে নির্বিবাদে খেয়ে থাকেন সাধারন গ্রোসারী ষ্টোরে সহজল্ভ্য বিভিন্ন কসাই খানা বা পোল্ট্রি হাউজে জবাই করা খাসী, গরু, মুরগীর গোশত।

এখানে বলে রাখা প্রয়োজন যে, কেউ যদি আল্লাহর নির্দেশ না মানে তাতে আল্লাহর কিছুই যায়-আসে না। কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বিশেষের খ্যদ্যাভ্যাস বা রুচি-অরুচির উপর আল্লাহ তো দূরের কথা আল্লাহর ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কোন সৃষ্টির ভাল-মন্দ বা সমান্য ক্ষতি-বৃদ্ধিরও কোনই সম্পর্ক নেই। আল্লাহর এইসব নির্দেশাবলী শুধুমাত্র মানুষের কল্যানের জন্যেই। আল-কোরআনের যাবতীয় শিক্ষা এবং আল্লাহর রসূল (সাঃ) ও তাঁর সাহাবা কেরাম (রাঃ)-এর জীবনীসমূহ শুধুমাত্র তাদের উপকারই নিশ্চিত করতে পারে যারা তা অনুসরন করতে চান। সব যুক্তি-তর্কের বৈজ্ঞানিক সমাধানের জন্য অপেক্ষা করতে হলে প্রজন্মের পর প্রজন্ম শেষ হয়ে যাবে কিন্তু সঠিক কার্যকারণ হয়তো জানাই যাবে না কখনও। সে ক্ষেত্রে ঐ সব ক্ষতিগ্রস্ত প্রজন্ম সমূহের দায়-দায়িত্ব কার? নিশ্চয়ই কোন বিশ্ব তার্কিক বা বিজ্ঞানী তাদের দায় নেবেন না। সেজন্যেই আল্লাহ পাকের এই আগাম ব্যবস্থা যেখানে তিনি নির্বাচিত জনগোষ্ঠীর মাঝে নিজের কর্ম পদ্ধতিগুলোকে বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছেন সেগুলোর ব্যবহারিক প্রয়োগের মাধ্যমে। সঠিক পদ্ধতিতে যবেহ করা প্রাণীর গোশত থেকে আহার করার ব্যপারটাও ঠিক তেমনি। যে তা অনুসরন করবে সে তার নিজের সুস্থতার জন্যেই তা করবে। এখানে আল্লাহ বা বিজ্ঞান করোরই চাওয়া-পাওয়ার কিছু নেই।

কিন্তু তারপরও অণুসন্ধিৎসু মন জানতে চায় হালাল যবেহ পদ্ধতির উপকারিতা। বিজ্ঞানময় আজকের এই যুগে এ সম্বন্ধে ধারনা পাওয়া অসম্ভব কোন ব্যপার নয়। উল্লেখ্য হালাল পদ্ধতিতে ধারালো ছুরির সাহায্যে প্রাণীর শ্বাসনালী ও সংলগ্ন রগগুলো যেভাবে কাটে ফেলা হয় সেটাই বস্তুতঃ নিশ্চিত করতে পারে সবচাইতে দ্রুততম সময়ে এবং নূন্যতম কষ্টে একটা প্রাণীর জীবনাবসান। উপরন্তু শুধু এই উপায়েই প্রাণী দেহের সমস্ত রক্ত এমন ভাবে নিঃশেষে বের করে দেয়া সম্ভব যাতে গোশতের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অংশগুলোর ভেতরে তা আর জমাট বাঁধার সুযোগ না পায়। তাই হালাল উপায়ে যবেহকৃত প্রাণীর গোশত খেলে গোশতের সাথে ক্ষতিকর রক্ত খেয়ে ফেলার সম্ভবনা নেমে আসে শূন্যের কোঠায়। মৃত্যুর পরপরই প্রাণী দেহের রক্ত দ্রুত জমাট বাঁধা শুরু করে বস্তুতঃ এই কারণেই উচু থেকে পড়ে বা অপঘাতে মারা যাওয়া প্রাণী, যাকে যবেহ করার সুযোগ পাওয়া যায়নি তার গোশত মূলতঃ পরিণত হয় অনেকটাই জমাট বাঁধা রক্তের পিন্ডে যা অত্যাধিক বিপদজনক মানুষের জন্যে, তাই সেটা হারাম। উল্লেখ্য মাছের রক্তে এসব সমস্যা নেই কারণ মাছের রক্ত শীতল যা প্রাণীর রক্ত থেকে সম্পূর্ণই আলাদা। উপরন্তু মাছের টুকরোর সাথে লেগে থাকা রক্ত সহজেই ধুয়ে ফেলা যায়।

এতো গেল শারীরিক লাভ-ক্ষতির হিসাব। এখানে আত্মার লাভ কোথায়? মূলতঃ সেটা নিশ্চিত করতেই মানুষকে সুনির্দিষ্ট ভাবে সেইসব প্রাণীর গোশত থেকে খেতে বলা হয়েছে যা যবেহ করা হয়েছে শুধুমাত্র আল্লাহর নামে, আল্লাহ ছাড়া অন্য করো নামে উৎসর্গিত প্রাণীর গোশত মানুষের জন্যে হারাম (২:১৭৩; ৫:৩; ৬:১১৮, ১২১)। দেহের মাঝে বিরাজমান ‘রূহ’ যেহেতু একান্ত ভাবেই আল্লাহর তাই তিনি বিনা অন্য কারো নামে উৎসর্গিত খাদ্য থেকে উৎসারিত শারীরিক শক্তি ও বৃদ্ধির মাঝে বসবাস এই ‘রূহ’-এর জন্যে নিঃসন্দেহে পীড়াদায়ক। তাই শুধুমাত্র আল্লাহর নামে যবেহকৃত গোশতই মানুষের জন্য হালাল তথা সর্বত উপকারী বলে ঘোষণা করেছে পবিত্র আল-কোরআন। ইহুদী-খ্রীস্টানদের মধ্যে যারা মুসা ও ঈসা (আঃ)-এর জীবন ব্যবস্থার উপর পূর্ণভাবে বিশ্বাসী তাদের যবেহ করা প্রাণীও মুসলমানদের জন্য হালাল (৫:৫) করণ মুসা ও ঈসা (আঃ) আমাদেরও নবী এবং পূর্বসূরী। তবে যেহেতু সাধারন গ্রোসারী বা ফাস্ট ফুড ষ্টোরের গোশতগুলোর যবেহ পদ্ধতি বা যবেহের উদ্দেশ্য নিশ্চিত ভাবে জানা সম্ভব হয় না তাই আত্মা ও শরীরের সার্বিক সুস্থতার স্বার্থে সেসব পরিহার করে চলাই নিরাপদ। সন্দেহজনক এই খাদ্য বা ক্ষেত্রগুলো হলো সীমান্ত এলাকার ‘জিরো লাইন’-এর মতই বিপদজনক, যদি সেখানে না গিয়েও জীবন চালানো সম্ভব হয় তবে সেটা করাই কি বুদ্ধিমানের কাজ নয়? এই একই কারণে শুয়োরের চামড়া বা দেহজাত প্রোটিন অথবা সেই দেহ থেকে ট্রান্সপ্লান্ট করা অস্থি-মজ্জা, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও পরিহারযোগ্য।

যারা তার্কিক তাদের জন্য এটুকু বিশ্লেষণই যথেষ্ট নয়। হালাল বলে বিক্রি হওয়া গোশত যে সত্যিই নির্দিষ্ট পদ্ধতি ও যথাযথ ভাবে আল্লাহর নাম নিয়ে যবেহ করা হয়েছে তা নিশ্চিত হওয়ার নিশ্চয়তা নিয়েও তারা প্রশ্ন তোলেন। এই কূটতর্কের সুযোগ আল্লাহ পাক নিজেই বস্তুতঃ এই বলে বন্ধ করে দিয়েছেন যে, অবস্থার প্রেক্ষিতে যদি হালাল কোন খাদ্য একান্তই পাওয়া না যায় তা হলে ‘স্বাদ গ্রহন’ না করার শর্তে শুধুমাত্র জীবন ধারনের পরিমান ‘হারাম’ খাদ্য গ্রহন করা যাতে পারে (২:১৭৩; ৬:১৪৫; ১৬:১১৫)। এ থেকে এটাই স্পষ্ট হয় যে মানুষের সর্বোচ্চ আত্মিক, মানসিক ও শারীরিক সুস্থতা ও সক্ষমতা নিশ্চিত করাই আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত হারাম-হালাল খাদ্য তালিকার মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।
বর্তমানের বস্তু সর্বস্ব বিদ্যা এতটাই অন্তঃসার শূন্য যে এই সব ‘কথিত শিক্ষায়’ শিক্ষিতরা প্রাণীর দুধ পান করার মধ্যেও খুঁজে পান হারাম-হালালের প্রশ্ন ও বিস্ময়। তাদের বক্তব্য, হারাম জবাইয়ের কারণে গরুর গোশত খাওয়া না গেলে তার দুধ পান করছি কি ভাবে? কে তাদেরকে বোঝাবে যে রক্ত-মাংসের মাঝ থেকে উৎপন্ন হলেও দুধের মধ্যে কোন রক্ত-মাংস থাকে না তাই দুধ পান আর সেই প্রাণীর গোশত খাওয়া এক কথা নয়। উপরন্তু ‘দুধ’-কে যেহেতু জবাই করা যায় না তাই সেটা কোন দেবতা-অপদেবতার নামে কোরবানী বা উৎসর্গ করাও সম্ভব নয় সেজন্যে দুধ কখনও হারাম হয় না। এই একই কারণে চাল-ডাল, তেল-মসলা, ফল-মূল-সবজীর ক্ষেত্রেও হারাম-হালালের কোরআনিক কোন নিয়ন্ত্রন দৃশ্যমান নয়।

[তিন]

আল-কোরআনের অনবদ্য ও অলংঘনীয় শিক্ষাকে আক্রমন করার ক্ষেত্রে এর বিরোধীদের কাছে সবচেয়ে মোক্ষম অস্ত্র হলো মুসলমানদের কোরবানী। যে কোন রক্তপাত হূদয়বিদারক। কোরবানীর রক্তপাতও তাই। এই সময়ে সৃষ্ট হূদয়ের বেদনার্ত দুর্বলতার মূহুর্তে অনেক মুসলমানও হয়ে পড়েন বিভ্রান্ত। বুঝতে ভুল করেন এই ইবাদতের তাৎপর্য এবং নিজের অজান্তেই কোরবানীর মধ্যে আবিষ্কার করেন ‘বর্বরতা’। আগ্রহী হয়ে ওঠেন ‘পশু জবাই’-এর বিকল্প অনুসন্ধানে। এরাই নাটকে, নোবেলে, টক শো আর সাহিত্যে পশুর মূল্য পরিমান অর্থ দান করে দেয়াকে কোরবানীর সমতুল্য ‘স্যাকরিফাইস’ হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা করেন। বিশ্বস্রষ্ঠা আল্লাহ পাক অবশ্যই জানতেন মানুষের মনের এই বিক্ষিপ্ত বিভ্রান্তির সম্ভবনার কথা। তাই তাঁর প্রিয় রসূল (সাঃ)-এর মুখে সুস্পষ্ট ঘোষণা দিয়ে শুরুতেই বন্ধ করে দিয়েছেন কোরবানীর সমতুল্য যে কোন ধরনের বিকল্পের সুযোগ, বলেছেন ‘কোরবানীর দিনে পশুর রক্তপাতই আল্লাহর কাছে সবচাইতে কাংক্ষিত ইবাদত’ (তিরমিজী, ইবনে মাজা’হ)। শুধু বক্তব্য দিয়েই থেমে থাকেননি রসূলুল্লাহ (সাঃ)। জীবনের শেষ পর্যায়ের কোরবানীতে নিজের বয়সের সমসংখক প্রায় ষাইটটি পশু নিজের হাতে জবাই করে বিশ্বকে বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন যে কোরবানীর দিন ‘পশুর রক্তপাতে’র কোন বিকল্প সম্ভব নয়। তাই পশু জবাই বাদ দিয়ে অন্য কোন উপায়ে কোরবানীর পূণ্য আদায়ের যে কোন চেষ্টা একেবারেই অর্থহীন এবং কোরআন ও সুন্নাহর সরাসরি পরিপন্থী।
কিন্তু কেন এই রক্তপাত? কেন নিজ হাতে কোরবানীর পশু জবাই করা এতটা তাৎপর্যপূর্ণ?

একটু খেয়াল করে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে আল্লাহ কর্তৃক মানুষের জন্যে নির্ধারিত ইবাদতগুলোর মূল উদ্দেশ্যই হলো মানুষের অন্তরে এই জীবনের ক্ষণস্থায়ীত্বকে প্রতিষ্ঠিত করে তাকে ইহজগতের মোহমুক্ত রাখা। যেমন প্রতিদিনের পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে নিজের যাবতীয় কাজ-কর্মের ফাঁকে ফাঁকে হঠাৎ সব কিছু থেকে মুখ ফিরিয়ে ‘আল্লাহু আকবর’ বলে মাটিতে মাথা ঠেকানোর অর্থ এটাই যে, সারা দিনমান আমি যত যা-ই করি না কেন সেসব আসলে আমার নয় বরং সর্বশক্তিমান মহান আল্লাহরই অনুগ্রহ মাত্র এবং দুনিয়াদারী ছেড়েছুঁড়ে মূহুর্তের নোটিশে নামজে দাঁড়িয়ে পড়ার মতই যে কোন মূহুর্তে আমি আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে এই নশ্বর ভূবন ত্যাগেও সদা প্রস্তুত। যাকাতের অবস্থাও তাই। নিজের উপার্জন নিজ হাতে বিলিয়ে দিয়ে আমরা আমাদের অন্তরকে এটাই বলে থাকি যে, এই সব অর্থ-কড়ি যা এই মূহুর্তে আমার তা বস্তুতঃ গতকাল পর্যন্ত ছিল অন্যের এবং নিশ্চিত ভাবেই আগামীকালও হবে অন্য করো, মাঝের এই সময়টুকু সেটা আমার পকেটে থাকাটা নিতান্তই মহান করুণাময় আল্লাহ পাকের পরম দয়া বৈ আর কিছুই নয়, তাই সেই আল্লাহরই নির্দেশে আল্লাহরই ওয়াস্তে তা বিলিয়ে দিতে আমার আপত্তি বা কার্পণ্য করার কিছু নেই। অর্থ-সম্পদের এই নিঃসংকোচ সম্প্রদানের মাধ্যমে বিশ্বজগত ত্যাগের মূহুর্তে সব সম্পর্ক ও সম্পদের মায়া ছেড়ে চলে যাওয়ার যে বাস্তবতা তার একটা অনুশীলনও যেন হয়ে যায় নিজের অজান্তেই। আর হজ্জ তো পুরোটাই কবর ও হাশরের এক দৃশ্যমান প্রতিচ্ছবি। বিশ্বের যাবতীয় সম্পর্ক চুকিয়ে কাফনের কাপড় গায়ে জড়িয়ে আরাফাতের সুবিশাল ময়দানে হাজির হওয়াটা শেষ বিচার দিবসেরই একটা সরাসরি ড্রেস রিহার্সেল বিশেষ। একই ভাবে কোরবানীর অবস্থাও বস্তুতঃ ভঙ্গুর এই পার্থিব জীবনের ক্ষণস্থায়ীত্বের স্পষ্ট স্মারকযুক্ত ও মৃত্যুকালীন ভয়াবহতার চাক্ষুষ নিদর্শনবহ।

পবিত্র কোরআনের ভাষ্য মতে মহাবিশ্বের সকল বস্তুই সৃষ্টি করা হয়েছে মানুষের কল্যানে ও প্রয়োজনে (2:১৬৪; ১৪:৩২~৩৪; ৪৫:১২~১৩)। এ জগতের সবকিছুই আল্লাহর নির্দেশে মানুষের প্রয়োজনীয় বিবিধ কাজে নিয়োজিত। এরমধ্যে মানুষের ক্ষুন্নিবৃত্তিতে পশু-পাখীর অকাতরে জীবন দান অন্যতম। প্রতিদিন মানুষের চাহিদা মেটাতে সরাবিশ্বে জীবন দিচ্ছে কোটি কোটি পশু-পাখী। যারা সভা-সমিতিতে কোরবানীকে ‘বর্বরতা’ বলে গলাবাজী করেন তারাও তাদের গলার শক্তি-সামর্থ্যের জন্যে মূলতঃ সেই পশু-পাখীর গোশতের উপরই নির্ভরশীল। এমনকি এসব বক্তব্যজীবীদের সভার আগে-পরে যে খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করা হয়ে থাকে তাতেও গোশতের দু’একটা আইটেম থেকে থাকে প্রায় নিশ্চিত ভাবেই। তাদের সমস্ত ক্ষোভ-বিক্ষোভ কোরবানীর ‘পশু হত্যা’ কেন্দ্রিক হলেও তাদের নিজেদের ‘সুস্বাস্থ্যময় সুখী জীবনের’ নিশ্চয়তা বিধানে বছরের প্রতিটি দিন বিশ্বের আনাচে-কানাচে কত শত কোটি পশু-পাখী কাতারে কাতারে অকাতরে কিভাবে যে প্রাণ দিয়ে চলেছে তা তারা জানতেও যেন আগ্রহী নন। চোখে ঠুলি আঁটা এসব ‘বিদগ্ধজন’দের দৃষ্টি খুলে দেয়ার দিন হলো এই কোরবানীর দিন। পরম করুণাময় আল্লাহ তা’য়ালা তাঁর সৃষ্ট কত শত কোটি প্রাণের বিনিময়ে টিকিয়ে রেখেছেন মানুষের জীবন ও সভ্যতাকে তা অতি প্রকটভাবে দৃশ্যমান হয় কোরবানীর দিনে। যে হূদয় অনুধাবন করতে পারে এই চরম সত্যকে তার পক্ষে ইহজীবনে আর কখনই সম্ভব নয় আল্লাহর প্রতি অকৃতজ্ঞ হওয়া অথবা আল্লাহর কোন সৃষ্টির প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ করা, নির্দয় হওয়া বা তার প্রতি কোন অবিচার করা। কোরবানী থেকে পাওয়া সত্যপোলব্ধির এই পরম শক্তিই একমাত্র পারে নিজের মাঝে বিরাজমান পশুত্বকে পরাভূত করে সেখানে শাশ্বত স্নেহ-মমতা ও পবিত্রতম প্রেম-ভালবাসাকে প্রতিষ্ঠিত করতে। বান্দার এই আত্মপোলব্ধিই সেই ‘তাকওয়া বা আল্লাহ ভীতির’ মূল যা কিনা কোরবানীর দিনে আল্লাহর দরবারে পৌঁছে থাকে বলে নিশ্চিত করা হয়েছে (২২:৩৬~৩৭)।

লক্ষ্যনীয়, কোরবানীর জন্যে হাঁস, মুরগী, কবুতরের মত সহজলভ্য পশু-পাখী নয় বরং ব্যবহূত হয়ে থাকে বয়ঃপ্রাপ্ত চতুষ্পদ গৃহপালিত পশু যাকে অনেক শ্রম আর যত্নের সাথে লালন-পালন করে বড় করে তুলতে হয় কোন স্নেহময় মনিবের ত্ত্ত্বাবধানে। কিন্তু কোরবানীর মূহুর্তে সেই সুষ্ঠাম-বলিষ্ঠ পশুটা যখন প্রাণ হারায় তখন তার শক্তিমত্ত দেহ কিম্বা তার মনিবের মমতা কোন কিছুই পারে না তাকে প্রাণে বাঁচাতে অথবা তার মৃত্যু যন্ত্রনাকে কিছুমাত্র লাঘব করতে। মৃত্যুর অবশ্যম্ভাবী বিধান তাকে মেনে নিতে হয় অতি অসহায় ভাবে। নিজে জবাই হয়ে সে তার জবাইকারীদেরকে চোখে অঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে যায় জীবনের অনিবার্য পরিণতি। বলে দিয়ে যায় যে মৃত্যুর ঐ অবশ্যম্ভাবী পরওয়ানা তাদের মাথার উপরও ঝুলছে ঐ একই ভাবে। পার্থক্য শুধু সময়ের, দু’দন্ড আগে আর পরে। কিন্তু নিয়তি এক, পরিণতিও এক। স্বজনদের আবেগ, ডিগ্রী আর প্রযুক্তির বেগ অথবা শক্তি-সামর্থ্য-সম্পদ কোন কিছুই রক্ষাকবচ হবে না, মুক্ত করতে পারবে না বরং ঐ একই ভাবে অসহায় চেয়ে রবে তাদের মৃত্যুকালেও। চরম সেই পরিস্থিতির মুখোমুখী হতে হবে যে কোন মূহুর্তে, চোখের পলকে এবং একাকী। ওয়ান টু ওয়ান মোলাকাতের ঐ অবস্থা কোরবানীর পশুর মত হবে, ভাল কিছু হবে নাকি তার চাইতেও ভয়াবহ হবে তা শুধুমাত্র তিনিই বলতে পারেন যিনি এই জীবন ও মরণের প্রকৃত মালিক, যার হাতে আছে সমস্ত জীবন আর মরণের লাগাম।

এই মহান দর্শনময় যে কোরবানী সেখানে গরু-খাসীর ঠ্যাং নিয়ে শহরজুড়ে ছুটোছুটি অথবা শাণিত ছুরি হাতে ঔদ্ধত্যপনা করে ভয়ার্ত দৃশ্যপট সৃষ্টির সুযোগ কোথায়? মূল আদর্শচূত্য এইসব বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিগত ঘটনাবলীর সমালোচনা করতে গিয়ে স্বয়ং কোরবানীকে আক্রমন করাটা তাই খুবই অসঙ্গত এবং অগ্রহণযোগ্য।

[চার]

সর্বশক্তিমান আল্লাহ তা’য়ালা তাঁর অন্তহীন সৃষ্টির মতই যে কোন ধরনের সীমা বা পরিসীমার উর্ধ্বে। সেই অসীমের যা কিছু নিয়ম, কানুন ও পদ্ধতি তা-ও তাঁর মতই অসীম-সীমাহীন তাৎপর্যময় এবং মহিমা মন্ডিত। সেসব উপলব্ধির জন্য যে শ্রম ও সাধনার প্রয়োজন তা যথার্থ ভাবে করতে পেরেছিলেন রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিজের হাতে গড়া সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) এবং তাদের অব্যাহত পরবর্তী তা’বাঈবৃন্দ যারা ছিলেন রসূলের সাহাবাদের সরাসরি ছাত্র। আমাদের সর্বশ্রদ্ধেয় চার ইমাম, আল-কোরআনের প্রথম তফসিরকারী পন্ডিতেরা এবং হাদীসের মহাজ্ঞান ভান্ডার সমূহের সূচনাকারীরা সবাই মূলতঃ ঐ প্রজন্মেরই প্রতিনিধি। বলাইবাহুল্য, রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর অবিনাশী ঐশ্বী শক্তির ত্ত্ত্বাবধানে থাকা ঐ মহাত্মারই মানব জাতির মধ্যে একমাত্র জনগোষ্ঠী যারা পৌঁছাতে পেরেছিলেন স্রষ্ঠার প্রকৃত ও একনিষ্ঠ ইবাদতের সর্বোচ্চ পর্যায়ে। সেজন্যে ঐ জনগোষ্ঠীর হাতেই পরমস্রষ্ঠা আল্লাহ তা’য়ালা পূর্ণতা দিয়েছেন তাঁর জীবন বিধান তথা দ্বীনকে (৫:৩)। এহেন মহাত্মাদের হাতে গড়া ব্যাখ্যা ও শিক্ষার বাহিরে গিয়ে কোরআন ও হাদীসের অন্য কোন ব্যাখা ও শিক্ষা যে সম্ভব বা গ্রহনযোগ্য হতে পারে না তা বোঝার জন্যে আলেম, হাফেজ বা মুহাদ্দিস হওয়ার প্রয়োজন হয় না। পরিবর্তীত সময় ও অবস্থার প্রেক্ষিতে কোরআন ও হাদীসের নতুন নতুন রিসার্স অবশ্যই হতে হবে এবং হতে থাকবে কিন্তু কোন গবেষণা ফলাফলই মূল ঐ ভিত্তির বাহিরে যেতে পারবে না কোন ভাবেই। যদি যায় তবে সেটা হবে রসুলুল্লাহ (সাঃ) প্রবর্তিত ইসলামে ‘নতুন সংযোজন বা বিয়োজন’ যাকে সাধারন ভাবে বলা হয় ‘বিদাহ’ যা সবচাইতে নিকৃষ্টতম এবং ভয়াবহতম ‘হারাম’ যার একমাত্র ও বে-হিসাব পরিণতি হলো সরাসরি জাহান্নাম।

এর অর্থ এই নয় যে কোরআন ও হাদীসের মাধ্যমে বর্তমান বা আগামী দিনের প্রযুক্তিগত বিপ্লবকে ধারন ও বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয় বরং বহু শতাব্দীকালের পুরোন বটবৃক্ষের মতই কোরআনিক মহাজ্ঞানের মূল এতটাই গভীর যে মানুষের এমন কোন জিজ্ঞাসা নাই বা হবেও না যার ব্যাখ্যা সে দিতে পারবে না। তবে এক্ষেত্রে এই উদাহরনটা মনে রাখতে হবে, বুঝতে হবে যে আজকের পৃথিবীতে নিত্য ব্যবহূত কম্পিউটার বা এমএস ওয়ার্ডের মত জনপ্রিয় সফটওয়্যারগুলো গণ-মানুষের জন্য দুধ-ভাতসম সহজবোধ্য হলেও বিশেষজ্ঞ ছাড়া এসবের ‘ট্রাবল শুটিং’ যেমন সম্ভব নয় তেমনি আল-কোরআন ও হাদীসের মহাজ্ঞানও সাধারন জন-মানুষের জন্য নিত্য ব্যবহার উপযোগী সহজবোধ্য হওয়ার পরও এর ভিত্তিতে বৈজ্ঞানিক বা প্রযুক্তিগত ‘ট্রাবল শুটিং’-এর জন্যে এই জ্ঞানে বিশেষজ্ঞ হওয়াটাও অত্যাবশ্যক। সাধারন ভাবে ব্যবহার্য বিদ্যা দিয়ে কম্পিউটার বা এর কোন সফটওয়্যার ঘাটতে গেলে যেমন ‘পোগ্রাম ক্র্যাশ-ফ্রিজ, ড্রাইভ ক্র্যাশ’ হয়ে ওঠে অনিবার্য তেমনি যেনতেন রকমের বিদ্যা দিয়ে কোরআন-হাদীস ঘাটতে গেলেও চিন্তা-চেতনা বিভ্রান্ত হতে বাধ্য, এমন কি তাতে জীবনও হতে পারে বিপন্ন।

অর্থৎ কোরআন ও হাদীসের উপর সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) ও তা’বাঈদের রচিত অক্ষত জ্ঞানভান্ডার সমূহ যা পৃথিবীর বিবিধ ভাষায় অনূদিত হয়ে আল্লাহর পথে নিবেদিত প্রাণ আলেম-ওলামাদের দ্বারা এখনও বিশ্বব্যাপী সদা প্রচারিত হচ্ছে সেগুলোই হলো সেইসব পরশ পাথর যার ছোঁয়ায় আমদের বস্তুগত সব নতুন নতুন জ্ঞান-বিজ্ঞান, আবিষ্কার ও প্রযুক্তিও হয়ে উঠতে পারে পরম করুণাময় আল্লাহ পাকের জন্যে উৎসর্গিত ইবাদতময় জীবনের নিত্য অণুঃসংগ। কিন্তু তা না করে সালাম-কালাম, হারাম-হালাল, কোরবানীর মত ইসলামের অতি আবশ্যক কর্তব্য ও ইবাদতগুলোকে এবং এসবের নিঃস্বার্থ ধারক-বাহক ও প্রচারক আলেম সমাজকে আজ যে ভাবে অর্বাচিনের মত কথায় কথায় আক্রমন ও অপব্যাখ্যা করা হচ্ছে তা রীতিমত মর্মান্তিক এবং দূর্ভাগ্যজনক। অতি সাধারন বিবেক-বোধ-বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের পক্ষেও ইসলামের এই সহজ বিষয়গুলো গুলিয়ে ফেলার কথা নয়। কিন্তু বস্তুগত ও সার্টিফিকেটমুখী শিক্ষা সর্বস্ব হুজুগময় আজকের এই সময় আমদের বর্তমান প্রজন্মকে এমন ভাবে দিকভ্রান্ত করে চলেছে যে তারা আলেয়াকেই ভাবছে আলো, আর প্রযুক্তির চশমা চোখে আলোকে মনে করছে বিভৎস আঁধার। কি ভয়ানক বিভ্রান্তি। আল্লাহ তাঁর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টিকে বিপর্যয়ের এই সর্বগ্রাসী থাবা থেকে রক্ষা করবেন এটাই আমাদের একান্ত প্রার্থনা।                                                                                                                                                                                              

মঈনুল আহসান

  লস এঞ্জেলস, ইউএসএ









No comments:

Post a Comment