Sunday, July 8, 2012

মিথ্যা সব গুনাহ্র মা


ইসলামের দৃষ্টিতে মিথ্যাচার একটি কবিরা গুনাহ। মহাগ্রন্থ আল কুরআনে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘তোমরা মূর্তিদের অপবিত্রতা থেকে বেঁচে থাকোএবং মিথ্যাকথন থেকে দূরে থাকো’ (সূরা হজ-৩০)। আরো ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশ্রিত কোরো না আর জেনেশুনে তোমরা সত্যকে গোপন কোরো না’ (সূরা বাকারা-৪২)।
মিথ্যাবাদীদের পরিণাম সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘বলে দিন, তোমরা পৃথিবীতে পরিভ্রমণ করো, অত:পর দেখো, মিথ্যারোপকারীদের পরিণাম কী হয়েছে’ (সূরা আনআম-১১)। আল্লাহতায়ালা আরো বলেন, প্রত্যেক মিথ্যাবাদী পাপাচারীর দুর্ভোগ (সূরা হাসিয়া-৭) অন্য একটি আয়াতে বলা হয়েছে, যেদিন কিয়ামত সংঘটিত হবে সেদিন মিথ্যাবাদীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে’ (সূরা হাসিয়া-২৭)।
সূরা মুরসালাতের দশটি আয়াতে আল্লাহতায়ালা একই কথার পুনরাবৃত্তি করেছেন। ইরশাদ হয়েছে আপনি জানেন বিচার দিবস কী? সেদিন মিথ্যাচারীদের দুর্ভোগ হবে।’ (মুরসালাত-১৪-১৫)। সেদিন মিথ্যাবাদীদের দুর্ভোগ হবেএ কথাটি আরো নয়টি আয়াতে বর্ণিত হয়েছে।
উপরিউক্ত আয়াতগুলোতে আল্লাহতায়ালা মিথ্যাকথন থেকে দূরে থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন। সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশ্রিত করতে নিষেধ করেছেন এবং সত্য গোপন না করতেও আদেশ করেছেন। তা ছাড়া মিথ্যাবাদীদের পরিণতি এবং দুর্ভোগ সম্বìেধ হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন।
ইসলামী শরিয়তের দ্বিতীয় উৎস হলো রাসূলুল্লাহ সা:-এর সুন্নাহ। রাসূলুল্লাহ সা: মিথ্যাচারকে কবিরা গুনাহ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, কবিরা গুনাহর মধ্যে তিনটি গুনাহ সবচেয়ে বড়। আবু বাকরা রা: থেকে বর্ণিত আমরা রাসূলুল্লাহ সা:-এর কাছে উপস্খিত ছিলাম। তখন তিনি বললেন, আমি কি তোমাদের সবচেয়ে বড় গুনাহ সম্পর্কে অবহিত করব না? তিনি এ কথাটি তিনবার বললেন। তার পর বললেন, সেগুলো হলো­ ১. আল্লাহর সাথে শিরক করা। ২. পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া এবং ৩. মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া কিংবা মিথ্যা কথা বলা। এ সময় রাসূলুল্লাহ সা: হেলান দিয়ে বসা ছিলেন। তিনি সোজা হয়ে বসলেন এবং কথাটি বারবার বলতে লাগলেন। এমনকি আমরা মনে মনে বলছিলাম আহা তিনি যদি থামতেন (সহিহ মুসলিম)।
আনাস রা: থেকে আরো একটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে। তিনি নবী করিম সা: থেকে কবিরা গুনাহ সম্পর্কে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, তা হলো : আল্লাহর সাথে শরিক করা, পিতা-মাতার নামফরমানি করা, কাউকে হত্যা করা এবং মিথ্যা কথা বলা (সহিহ মুসলিম)।
অতএব, মিথ্যাচার যে কবিরা গুনাহ অর্থাৎ মহাপাপ তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
মিথ্যাবাদীদের সংজ্ঞা বর্ণিত হয়েছে আল কুরআনে এবং হাদিস শরিফে। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘মিথ্যা কেবল তারাই রচনা করে যারা আল্লাহর নিদর্শনে বিশ্বাস করে না এবং তারাই মিথ্যাবাদী’ (সূরা নাহল-১০৫)। মুসলিম শরিফের একটি হাদিসে আবু হুরায়রা রা: বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘কোনো ব্যক্তির মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে যা শোনে তা বলে বেড়ায় (মুসলিম, মুকাদ্দামা অধ্যায়)। আবু ওসমান আল নাহদী রা: বর্ণনা করেন, ওমর রা: বলেছেন, কোনো ব্যক্তি মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে যা শোনে তা বলে বেড়ায় (মুসলিম মুকাদ্দামা অধ্যায়)। বর্ণিত যে, তিনি রাসূলুল্লাহ সা:-কে বলতে শুনেছেন সে ব্যক্তি মিথ্যাবাদী নয়, যে মানুষের মধ্যে মীমাংসা করার জন্য ভালো কথা পৌঁছে দেয় কিংবা ভালো কথা বলে (বুখারি)।
আল হাদিস বর্ণনাকারীরা মিথ্যাবাদী। মিথ্যাকথনই যখন কবিরা গুনাহ তখন কেউ যদি রাসূলুল্লাহর সা: ওপর মিথ্যা আরোপ করে এবং তার নামে মিথ্যা হাদিস বর্ণনা করে তবে তা গুরুতর অপরাধ। এ সম্পর্কে অনেক হাদিস রয়েছে।
আনাস ইবনে মালিক রা: থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, তোমাদের কাছে অধিকসংখ্যক হাদিস বর্ণনা করা থেকে যা আমাকে বিরত রাখে তা হলো রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, যে ব্যক্তি স্বেচ্ছায় আমার প্রতি মিথ্যা আরোপ করে সে যেন নিজের বাসস্খান জাহান্নামে নির্ধারণ করে নেয়। (বুখারি ও মুসলিম)। আবু হুরায়রা থেকেও অনুরূপ হাদিস বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, যে ব্যক্তি ইচ্ছা করে আমার প্রতি মিথ্যা আরোপ করে সে যেন জাহান্নামে তার বাসস্খান নির্ধারণ করে নেয় (মুসলিম, মুকাদ্দামা অধ্যায়)। আরো একটি হাদিস সালমা ইবনে আকওয়া রা: থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি নবী করীম সা:-কে বলতে শুনেছি যে ব্যক্তি আমার ওপর এমন কথা আরোপ করে যা আমি বলিনি, সে যেন জাহান্নামে তার ঠিকানা বানিয়ে নেয় (বুখারি)।
জইফ হাদিস বর্ণনা করা এবং সংগ্রহ করার ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বনের নির্দেশ রয়েছে অনেক হাদিসে। আবু হুরায়রা রা: বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘শেষ যুগে কিছুসংখ্যক প্রতারক ও মিথ্যাবাদী লোকের আবির্ভাব ঘটবে। তারা তোমাদের এমন সব হাদিস বর্ণনা করবে যা তোমরা এবং তোমাদের পূর্বপুরুষরা শোনেনি। সুতরাং তাদের সংসর্গ থেকে সাবধান থাকবে এবং তাদের দূরে রাখবে। তারা যেন তোমাদের গোমরাহ না করে এবং তোমাদের যেন ফেতনায় না ফেলে (মুসলিম)।
তার পরও সারা বিশ্বে অসংখ্য জাল হাদিসের প্রচলন রয়েছে। একশ্রেণীর অতিউৎসাহী আলেম জাল ও জইফ হাদিস প্রচার করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। তাদের সাথে রয়েছে ইহুদি, খ্রিষ্টান ও মুশরিক চক্রের দুরভিসìিধ।
বাংলাদেশেও অসংখ্য আলেম জাল হাদিস প্রচার করে থাকেন। সত্য-মিথ্যা যাচাই-বাছাই না করে জইফ হাদিস বর্ণনা করে থাকেন। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যেতে পারে­ অনেকে বলেন, ‘বিদ্যা শিক্ষার জন্য চীন দেশে যাও।এটা রাসূলুল্লাহ সা:-এর উক্তি নয়। এটি আরব দেশের একটি প্রবাদ বাক্য। কেউ কেউ বলেন, ‘স্বামীর পায়ের তলায় স্ত্রীর বেহেশত’­ এটাও মিথ্যা হাদিস।
বাংলাদেশের ৯০ শতাংশ লোক মুসলিম অথচ তারা মিথ্যাচার পরিহারের প্রতি গুরুত্বারোপ না করে অহরহ মিথ্যা কথা বলে থাকেন। সত্যবাদী লোকের সংখ্যা নিতান্তই কম। তবে মিথ্যাবাদীদের মধ্যে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছেন রাজনীতিবিদরা। ব্যতিক্রধর্মী কিছু রাজনীতিবিদ ছাড়া বেশির ভাগ রাজনীতিবিদ অনর্গল মিথ্যাচার করে থাকেন। তারা মনে করেন যে, মিথ্যাচার ছাড়া রাজনীতি করা যায় না। তারা মিথ্যাকথনকে কোনো অপরাধ মনে করেন না
অনেকের ধারণা, কিছু দিন ধরে কিছু লোক একটা মিথ্যা কথা বলতে থাকলে তা সত্যে পরিণত হয়। ইতিহাস সম্বìেধ অনভিজ্ঞ এসব অদূরদর্শী রাজনীতিবিদ ভুলে থাকতে চান হিটলারের প্রধানমন্ত্রী গোয়েবলসের মিথ্যাচারের কাহিনী। মিথ্যাচারের কারণে গোয়েবলস ইতিহাসে কুখ্যাত হয়ে আছে। লোকে তাকে ধিক্কার দিচ্ছে। তা সত্ত্বেও সারা বিশ্বে এখন অগণিত গোয়েবলস রয়েছে যারা মিথ্যাকথনকে দোষ মনে করে না। সত্য সব সময়ই সত্য। মিথ্যাচার করে সত্য ঘটনা ধামাচাপা দেয়া যায় না। আগে হোক, পরে হোক ইতিহাসের কাঠগড়ায় শাসকদের সবাইকে দাঁড়াতে হয়। তখন মিথ্যাবাদী নেতারা আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়।
সাধারণ মানুষও নানাভাবে মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে থাকে। বাংলাদেশে জন্ম নিবìধনের কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা কার্যকর নেই। সেই সুযোগে অভিভাবকরা তাদের ছেলে-মেয়েদের বয়স ইচ্ছামতো কমিয়ে দেন এসএসসি সার্টিফিকেটে। এ সংস্কৃতি ঘরে ঘরে চালু রয়েছে। ব্যতিক্রমধর্মী দু-একজন অভিভাবক ছাড়া সবাই তাদের ছেলে-মেয়েদের বয়স কমিয়ে থাকেন। অর্থাৎ মিথ্যার আশ্রয় নেন। এ কারণে সার্টিফিকেটে উল্লেখিত জন্মদিনের সাথে প্রকৃত জন্মদিনের মিল থাকে না।
অন্যভাবে একটি মিথ্যাচার জমির ক্রেতা-বিক্রেতারা করে থাকেন। জমিজমা বেচাকেনার সময় দলিলে প্রকৃত মূল্য উল্লেখ করা হয় না। চড়প-পশয়মসষ করে কেউ যেন জমি বাগিয়ে নিতে না পারে সে জন্য প্রকৃত ক্রয় মূল্যের চেয়ে অধিক মূল্য দলিলে উল্লেখ করা হয়। বর্তমানে রেজিস্ট্রেশন ফি বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে ক্রয় মূল্যের চেয়ে কম মূল্য লেখা শুরু হয়েছে। এখানে চলছে মিথ্যার ছলচাতুরি।
বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা অনেকেই মিথ্যাকথনে পারদর্শী। তাদের মিথ্যাচার লোকে বিশ্বাস করবে এ ধারণায় তারা মিথ্যা চমক সৃষ্টি করেন। বিনিময়ে প্রচুর রোজগার করে থাকেন।
অফিস-আদালতে, ব্যবসায়-বাণিজ্যে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, পথে-ঘাটে, ঘরে-বাইরে সর্বত্র মিথ্যার ছড়াছড়ি। মিথ্যাচার ছাড়া ওকালত ব্যবসা অচল। ঘুষ নিতে মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয়। ব্যবসায়-বাণিজ্য মিথ্যাচার ছাড়া সম্ভব হয় না। মিথ্যার আশ্রয় না নিলে ব্যবসায়ীরা কোটিপতি হতে পারে না। যারা মানুষ গড়ার কারিগর তারা এখন শিক্ষা নিয়ে ব্যবসায় শুরু করেছেন।
আমরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলি, সন্ত্রাস দমন করার জন্য পদক্ষেপ নিয়ে থাকি। চাঁদাবাজি ìধ করার জন্য লোকদেখানো কৌশল অবলম্বন করি, কিন্তু মিথ্যাচার বìধ করার জন্য উচ্চবাচ্য করি না। ইদানীং দু-একজন লেখক মিথ্যাচারের বিপক্ষে লিখছেন, এটা একটি শুভ লক্ষণ। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘বলুন, সত্য এসেছে, মিথ্যা বিলুপ্ত হয়েছে, নিশ্চয়ই মিথ্যা বিলুপ্ত হওয়ারই ছিল’ (সূরা বনি ইসরাইল-৮১)। একমাত্র মিথ্যাবাদীরাই কুরআন অস্বীকার করে। তবে সত্য প্রতিষ্ঠিত হবেই।

উপাধ্যক্ষ (অব:) মোহাম্মদ আব্দুল হাই

No comments:

Post a Comment