Wednesday, March 12, 2014

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস



sefatuli.blogspot.com
কুষ্টিয়া: কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ জেলার মধ্যবর্তী প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের শোভায় শুশোভিত শান্তিডাঙ্গা-দুলালপুরের ১৭৫ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত দেশের একমাত্র পাবলিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। আধুনিক ও ইসলামী শিক্ষার সমন্বয় সাধনের লক্ষ্যে ১৯৭৯ সালের ২২ নভেম্বর তৎকালীন প্রেসিডেন্ট শহীদ জিয়াউর রহমান এটি প্রতিষ্ঠা করেন। তখন মূলত এটি ছিল, ওআইসি পরিচালিত মুসলিম বিশ্বে ৩টি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি।

 
দেখতে দেখতে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় তার প্রতিষ্ঠার ৩৩ বছর অতিক্রম করছে। ৩৩ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো ও পরিচিতিও বেড়েছে অনেক। ১৯৮৫-৮৬ শিক্ষাবর্ষ থেকে মাত্র দুটি অনুষদের অধীন চারটি বিভাগে ৩০০ ছাত্র ভর্তির মাধ্যমে এবং আট জন শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়েছিল।

 
আজ ২২ নভেম্বর ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স ৩৩ বছরে পূর্ণ হচ্ছে। পা দিচ্ছে ৩৪বছরে।




প্রতিষ্ঠার ইতিহাস :


বাংলাদেশে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পেছনে রয়েছে শত শত বছর থেকে রচিত এক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট। হালাকু খানের বাগদাদ ধ্বংস, কর্ডোভার পতন ও সর্বশেষ ওসমানিয়া খেলাফতের পতনের পর জ্ঞান-বিজ্ঞানের সব শাখায় মুসলমানদের পদচারণা শূন্যের কোঠায় নেমে আসে।


ত্রয়োদশ শতাব্দীর সূচনা লগ্নে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজী বাংলাদেশে মুসলিম শাসন প্রবর্তন করেন এবং তিনি ইসলামী দর্শনের ভিত্তিতে একটি শিক্ষা ব্যাবস্থারও প্রবর্তন করেন যা ১৭৫৭ সনে ইংরেজ বেনিয়ারা বাংলার মসনদ দখল পর্যন্ত সুদীর্ঘ ছয়শত বছর যাবৎ চালু ছিল। ইংরেজরা ১৭৫৭ সনে এদেশ দখলের পরও প্রায় আশি বছর অবধি তথা ১৮৩৫ সন পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। তখন থেকে শত শত বছরের চিন্তা-চেতনা, আত্মোপলব্ধি , আন্দোলন, সংগ্রাম, কমিটি গঠন ও সুপারিশের মাধ্যমে রচিত সুদীর্ঘ প্রেক্ষাপটের ঐতিহাসিক ধারায় প্রতিষ্ঠিত হয় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়।

  অবিভক্ত ভারতবর্ষে  ইংরেজদের প্রণীত শিক্ষানীতি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মুসলমানদের চিন্তা-চেতনায়, মননে ইংরেজ বানানোর প্রক্রিয়া চলতে থাকে। তখন থেকেই মুসলমানদের জন্য উচ্চ শিক্ষার বিদ্যাপীঠ হিসেবে একটি স্বতন্ত্র ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবিতে প্রবল আন্দোলন গড়ে ওঠে। যে আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামবাদী, মাওলানা আকরাম খাঁ,  মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী প্রমুখ।

 
মাওলানা ইসলামবাদী ১৯২০ সালে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য চট্টগ্রামের পটিয় থানার অন্তর্গত সমুদ্র তীরবর্তী দেয়াং পাহাড়ে ৬০০ বিঘা জমি সংগ্রহ করেছিলেন। ১৯৩৫ সালে মাওলানা শওকত আলী এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহকে ভিসির দায়িত্ব প্রদানের সুপারিশ করেন। পাকিস্তান আমলে তৎকলীন শাসকরা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আন্দোলন থামনোর জন্য বিভিন্ন কমিটি গঠন ও প্রতারণামূলক ঘোষণা প্রদান করা ছাড়া আর কিছুই করেনি।

 
১৯৭১-এ স্বাধীনতা যুদ্ধের পর বাংলাদেশে জোরালোভাবে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি ওঠে। এক পর্যায়ে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পর দেশের জনগণের দীর্ঘদিনের দাবির যৌক্তিকতা ও গুরুত্ব উপলব্ধি করে ১৯৭৬ সালের ১ ডিসেম্বর দেশে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন।


ঘোষণার পর ১৯৭৭ সালের ৩১ মার্চ থেকে ৯ দিনব্যাপী মক্কায় অনুষ্ঠিত ওআইসির আন্তর্জাতিক ইসলামী শিক্ষা সম্মেলনে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে একটি প্রতিনিধিদল অংশ নিয়ে বিশ্বে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে একটি প্রবন্ধ পাঠ করেন।


ওই প্রবন্ধের আলোকে পাকিস্তান, মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সিদ্ধান্ত মোতাবেক ১৯৭৯ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি জিয়াউর রহমান ঢাকায় একটি প্রকল্প অফিস করে লন্ডন প্রবাসী ড. মমতাজ উদ্দিন চৌধুরীকে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকল্প পরিচালক নিযুক্ত করেন।

 
সময় প্রথমে গাজীপুরে, পরে যশোরে এবং শেষে কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ জেলার যথাক্রমে ২৪ ও ২২ কিলোমিটার মধ্যবর্তী শান্তিডাঙ্গা-দুলালপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান চূড়ান্ত করা হয় এবং ১৭৫ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। ১৯৭৯ সালের ২২ নভেম্বর শহীদ জিয়াউর রহমান এখানে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়ার সরকার জাতীয় সংসদে সর্বপ্রথম The Institute of the Islamic Education and Research Act 1980 (31) পাস করে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশে উচ্চতর ইসলামী শিক্ষার প্রথ সুগম হয় এবং আধুনিক শিক্ষা ও বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার সাথে ইসলামি জ্ঞানের সমন্বয় সর্বপ্রথম সরকারি স্বীকৃতি লাভ করে।

 
সংসদে ১৯৮০ সালের ২৭ ডিসেম্বর Islamic University Act 1980 (37) পাস হয়। এই Act   প্রণয়নের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যরূপে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়: ক. স্নাতক ও স্নাকোত্তর পর্যায়ে ধর্মতত্ত্ব ও ইসলামী শিক্ষার অন্যান্য শিক্ষা শাখাগুলোতে এবং তুলনামূলক আইন বিজ্ঞান ও এরূপ শিক্ষণ শাখাগুলোয় শিক্ষাচর্চার ব্যবস্থা করা।

 
কলা ও বিজ্ঞানের বিবিধ শাখার সাথে ইসলামী শিক্ষার সংযোগ ও সমন্বয় সাধন। খ. নতুন আঙ্গিকে মাদ্রাসা শিক্ষার উন্নয়ন ও পুনর্বিন্যস্তকরণ। গ. ঐশিক ও জাগতিক জ্ঞানের বিবিধ ক্ষেত্রে উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষণার মাধমে দেশে একটি সুসংহত শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জন।


কিন্তু পরবর্তী সময়ে প্রেসিডেন্ট হুসেইন মহম্মদ এরশাদ এক অর্ডিন্যান্সে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট সংশোধন করে ১৯৮৩ সালের ২১ জুলাই ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়া থেকে গাজীপুরে স্থানান্তর করেন। এলাকাবাসীর আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ৯০ সালের ২ জানুয়ারি পুনরায় তা কুষ্টিয়ায় স্থানান্তরিত করেন। ওই সময় কুষ্টিয়ায় বিভিন্ন ভাড়া করা ভবনে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু হয়।


ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান অবকাঠামো :


১৭৫ একর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। অসংখ্য ভবন ও মাঠ আকর্ষণীয়ভাবে সজ্জিত এ ক্যাম্পাস। বর্তমানে পাঁচটি অনুষদের অধীনে ২২টি বিভাগে পরিচালিত হচ্ছে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম। ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার, ক্যাম্পাসে আবাসনের জন্য ছাত্রদের আন্তর্জাতিক মানের একটিসহ চারটি এবং ছাত্রীদের জন্য দুটি আধুনিক আবাসিক হল রয়েছে। শেখ হাসিনা নামে আরো একটি ছাত্রী হল নির্মানাধীন। এসব হলে প্রায় আড়াই হাজার শিক্ষার্থীর আবাসন ব্যাবস্থা রয়েছে। শিক্ষক-কর্মকর্তা কর্মচারীদের জন্য ৯টি কোয়ার্টার এবং ভাইস-চ্যান্সেলরের জন্য অত্যাধুনিক বাসভবন রয়েছে। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মসজিদ (নির্মাণাধীন) এখন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে। এছাড়া রয়েছে উন্নতমানের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি এবং কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে ডিজিটাল লাইব্রেরি, মেডিকের সেন্টার,  জিনন্যাসিয়াম,  অত্যাধুনিক অডিটোরিয়াম,  কম্পিউটার সেন্টার,  শহীদ স্মৃতিসৌধ,  মুক্তবাংলা ভাস্কর্য, প্রশাসন ভবন, চারটি একাডেমিক ভবন এবং সর্বোপরি সুদৃশ্য ও অত্যাধুনিক প্রধান গেট। 


সমন্বিত শিক্ষা ব্যাবস্থা উপেক্ষিত :


আধুনিক ও ইসলামী শিক্ষার সমন্বয় সাধনের লক্ষ্যে যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল প্রতিষ্ঠার ৩৩ বছরেও সে সমন্বিত শিক্ষা ব্যাবস্থার রূপরেখা প্রতিফলিত হয়নি ।ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন অনুষদ ও বিভাগে প্রচলিত শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচির পর্যালোচনা করলে আমাদের চরম হতাশায় নিমজ্জিত হতে হয়। এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিরোনামে ইসলামীশব্দটি ছাড়া সমন্বিত শিক্ষা ব্যাবস্থার কোন চরিত্র  এতে বিদ্যমান নেই। ইসলাম বিষয়ক কোনো জ্ঞানার্জন কিংবা অধ্যয়নকে যেন ধর্মতত্ত্ব অনুষদের চার দেয়ালের মধ্যে এমনভাবে বন্দী করে রাখা হয়েছে যাতে অন্য কোনো অনুষদ কিংবা বিভাগেই যেন এর প্রবেশাধিকার না ঘটে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষদ ও বিভাগে প্রবর্তিত পাঠক্রম পর্যালোচনা করে দেখা যায়,  হাতে গোনা দু'একটি বিভাগের পাঠ্যক্রমে আন্ডার গ্রাজুয়েট প্রোগ্রামের অনেকগুলো কোর্সের মধ্যে ইসলামী শিক্ষার একটি মাত্র কোর্সের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গেলেও তা অধ্যয়ন বাধ্যতামূলক নয়। কোনো শিক্ষার্থী নিজ আগ্রহে এ কোর্সটি অধ্যয়ন করলেও এর অনুপাত হবে তার পুরো পাঠ্যসূচির ৩ শতাংশ মাত্র।

 
ইবি' অধীন ফাজিল স্নাতক এবং কামিল স্নাতকোত্তর ডিগ্রি প্রদানের ব্যাবস্থা :


দেশের সকল ফাজিল ও কামিল মাদ্রাসাকে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করে ২০০৬ সালের অক্টোবর মাসে ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় (সংশোধনী) অ্যাক্ট-২০০৬’  নামে জাতীয় সংসদে একটি আইন পাস হয়। এ আইনের ১২ ধারার (১) উপধারায় বলা হয়েছে, ‘এই আইন কার্যকর হবার সাথে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের অধিভুক্ত ও অঙ্গীভূত সকল ফাজিল ও কামিল মাদ্রাসা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ও অঙ্গিভূত হিসেবে গণ্য হবে।


১২ ধারার (২) উপধারায় বলা হয়েছে, এই আইন প্রবর্তনের অব্যবহিত পর হতে ফাজিল ও কামিল মাদ্রসায় অধ্যয়নরত ছাত্রছাত্রীরা এই আইনের অধীন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী বলে গণ্য হবেন।



এ আইনের ফলে উক্ত দু'শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা অত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বিএ ও এমএর মান পাচ্ছে।


জাক আজ আর না পরে এক সময় আবার ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে আর ও কিছু জানলে জানাবো
                           আল্লাহ হাফেয ।

                          শিফাতুল ইসলাম

No comments:

Post a Comment